ভাস সমস্যা | উচ্চ-মাধ্যমিক সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস

 

Vas samasya | Hs Sanskrit sahitter itihas


ভাস সমস্যা


১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় টি. গণপতি শাস্ত্রী দক্ষিণ ভারতে ১০৫টি তালপাতার পুথিতে লিখিত কতকগুলি নাটক আবিষ্কার করেন। ওই পুথিতে দেখা গেল ১০ খানি নাটক এবং আর একটি অসমাপ্ত রূপক। পরে ওই ধরনের আরও দু-খানি রূপক আবিষ্কৃত হল। এই ভাবে মোট ১৩খানি রূপকের সন্ধান পাওয়া গেল। ওই নাটকগুলির রচয়িতার কোনো নামোল্লেখ ওই পুথিতে ছিল না। বহু আলোচনা ও গবেষণার পর শাস্ত্রী ওই নাটকগুলি ভাস কর্তৃক রচিত বলে ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন—

(১) ওই নাটকগুলি কালিদাস, অশ্বঘোষ প্রমুখ অন্যান্য নাট্যকারগণের নাটক অপেক্ষা স্বতন্ত্র এক নতুন ধারায় রচিত এবং এগুলি অনেক ক্ষেত্রেই নাট্যশাস্ত্রের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। 

(২) কালিদাসের নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃত অপেক্ষা এই নাটকগুলিতে ব্যবহৃত প্রাকৃত প্রাচীনতম। 

(৩) পাণিনির ব্যাকরণের নির্দেশও এই নাটকগুলিতে অনেকক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়েছে। 

(৪) ওই নাটকগুলিতে 'প্রস্তাবনা'র পরিবর্তে স্থাপনা পদের প্রয়োগ করা হয়েছে এবং স্থাপনায় নাট্যকারের নামের কোনো উল্লেখ নেই। 

(৫) উক্ত নাটকগুলিতে স্থাপনার পরিবর্তে গ্রন্থশেষে পুষ্পিকায় গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

(৬) নান্দী শ্লোকে মুদ্রালংকার প্রয়োগ করা হয়েছে এবং শেষের দ্বারা প্রধান চরিত্রগুলির উল্লেখ করা হয়েছে।

(৭) কতিপয় নাটকে একই প্রকার ভরতবাক্যের প্রয়োগ করা হয়েছে। 

(৮) বিভিন্ন নাটকে একই বাগধারা, একই প্রকার শ্লোক ও বাক্যগঠনরীতি, একই পতাকাস্থান, নাট্যকৌশল, কবিকল্পনা, সামাজিক অবস্থার চিত্র প্রভৃতি বহুবিধ সাদৃশ্যের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে নাটকগুলি একই নাট্যকারের রচনা। 

(৯) রাজশেখর বলেছেন যে ভাসের অনেকগুলি নাটক ছিল এবং সেগুলির মধ্যে স্বপ্নবাসবদত্তা শ্রেষ্ঠ। আবিষ্কৃত নাটকগুলির মধ্যে স্বপ্নবাসবদত্তা নাটকটি পাওয়া গেছে। অতএব নাটকগুলি ভাসের রচিত। 

(১০) কালিদাস, বাণভট্ট প্রমুখ অনেকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহকারে ভাসের নাম উল্লেখ করায় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ভাস ছিলেন প্রাক্ কালিদাস যুগের কবি এবং এক খ্যাতনামা নাট্যকার। 

(১১) বাণভট্ট বলেছেন যে ভাসের নাটকগুলি সূত্রধারের দ্বারা আরম্ভ হয়েছে এবং সেগুলিতে অনেক পাত্রপাত্রী এবং পতাকা আছে। এই লক্ষণগুলিও আবিষ্কৃত নাটকগুলির সঙ্গে মেলে। 

    এই সব যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে গণপতি শাস্ত্রী প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে নাটকগুলি একই নাট্যকারের রচনা এবং সেই নাট্যকার হলেন ভাস। 

   কিন্তু এগুলি ভাসের রচনা কিনা সে বিষয়ে পণ্ডিত রামাবতার শর্মা, হিরানন্দ শাস্ত্রী প্রমুখ পণ্ডিতগণ সন্দেহ প্রকাশ করেন। এরূপ সন্দেহের পক্ষে তাঁরাও নিম্নলিখিত যুক্তিগুলির অবতারণা করেছেন— 

(১) আবিষ্কৃত নাটকগুলির কোনোটিতেই নাট্যকারের নাম উল্লিখিত নেই। এগুলি থেকে পরবর্তী অনেক গ্রন্থে উদ্ধৃতি পাওয়া গেলেও সেগুলি কার রচনা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে তা কোনো গ্রন্থকার উল্লেখ করেননি। 

(২) ভাসের রচনা এবং স্বপ্নবাসবদত্তা থেকে গৃহীত বলে পরবর্তী গ্রন্থকারগণ এমন উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেগুলি আবিষ্কৃত নাটকে পাওয়া যায় না। 

(৩) বাণভট্ট ভাসের নাটকের যে লক্ষণগুলি বলেছেন সেগুলি এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলিও কেবলমাত্র আবিষ্কৃত নাটকগুলির বৈশিষ্ট্য নয়, দক্ষিণ ভারতীয় সকল নাটকেই একই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। 

(৪) নাট্যশাস্ত্রের নির্দেশ লঙ্ঘন করার ব্যাপারেও ওই একই কথা বলা যায়। 

(৫) কালিদাসের নাটকগুলির ভাষা ও প্রাকৃত অপেক্ষা ওই নাটকগুলির ভাষা ও প্রাকৃতের প্রাচীনত্বের ব্যাপারে বলা যায় যে, এটি পুঁথির প্রাচীনত্ব বোঝালেও নাট্যকারের প্রাচীনত্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করতে পারে না।

(৬) অপাণিনীয় প্রয়োগগুলি সম্ভবত লিপিকর-প্রমাদের ফলেই ঘটেছে। একই ভরতবাক্য, বাগধারা, শব্দপ্রয়োগ কৌশল প্রভৃতি লিপিকার অথবা নাট্যনির্দেশক অভিনেতা বা লিপিকর পণ্ডিতগণের দ্বারা মূল রচনায় সংযুক্ত। 

(৭) প্রকৃতপক্ষে নাটকগুলি কেরালার চকিয়ার নামক নাট্যসম্প্রদায়ের কাছে পাওয়া গেছে। ওই নাট্যসম্প্রদায় সাধারণত বিভিন্ন নাট্যকারের নাটক বা নাট্যাংশ গ্রহণ করে রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজন অনুসারে সম্পাদনা করে অভিনয় করে থাকেন। আবিষ্কৃত নাটকগুলি বিভিন্ন অজ্ঞাতপরিচয় নাট্যকারের নাটক বা নাট্যাংশ এবং একই ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের দ্বারা সম্পাদিত। সেই কারণে এগুলিতে একই ধরনের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত। এবং একই ব্যক্তির রচনা বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়।

    এই সব বাদানুবাদের ফলে ভাসের আবিষ্কৃত নাটকগুলি “ভাস সমস্যা” নামে অভিহিত। এবং তেমন কোনো অকাট্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত শাস্ত্রীর মতানুসারে নাটকগুলি ভাসের রচিত বলেই স্বীকার করে নেব।

Post a Comment

0 Comments