অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটক | টীকা, নাটকের বিষয়বস্তু, নাটকের উৎকর্ষ | avigyan shakuntalam in bengali

shakuntala story in bengali pdf | অভিজ্ঞান শকুন্তলম প্রশ্ন উত্তর


 অভিজ্ঞানশকুন্তলা 

 মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে লেখা সপ্তাঙ্ক নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলা কালিদাসের এক অতুলনীয় সাহিত্যসৃষ্টি। মূল বিষয় কণ্বের আশ্রমলালিতা কন্যা শকুন্তলা ও পুরুবংশের রাজা দুষ্মন্তের প্রেম ও গান্ধর্ব মতে বিবাহ। একদা মৃগয়াবিহারী দুষ্মন্ত এক হরিণের পিছনে রথ ছোটাতে ছোটাতে মহর্ষি কন্বের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। সেখানে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা নামে দুই সখীর সঙ্গে শকুন্তলা আশ্রমবৃক্ষের আলবালে জল দিচ্ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে দুষ্মন্তের দেখা হল। প্রথম দর্শনেই রাজা অপরূপ লাবণ্যময়ী শকুন্তলার রূপের মোহে মজলেন। শকুন্তলাও রাজার রূপে আকৃষ্ট হলেন। কথাপ্রসঙ্গে রাজা শকুন্তলার নাম-ধাম, জন্মবৃত্তান্ত জেনে খুবই আশ্বস্ত হলেন। ইত্যবসরে এক বুনো হাতি আশ্রমে ঢুকে পড়লে আশ্রমবাসী সকলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। শকুন্তলা আর তাঁর সঙ্গীরা অভ্যন্ত চলে গেলেন। রাজাও নিজের শিবিরে ফিরলেন। রাক্ষসেরা কণ্বের আশ্রমে ভীষণ উপদ্রব করছে - ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। তাই কণ্বের দুই শিষ্য এসে যজ্ঞরক্ষার জন্য রাজা দুষ্মন্তকে পুনরায় আশ্রমে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন। অন্যদিকে রাজধানী থেকে দূত এসে জানালো যে রাজমাতা ছেলের মঙ্গলের জন্য ব্রত করেছেন। তাঁর ব্রত শেষ হয়েছে। তাই রাজাকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে। দুষ্মন্ত উভয় সংকটে পড়লেন। কিন্তু তিনি সুকৌশলে নিজের পরিবর্তে বিদূষককে রাজমাতার কাছে পাঠিয়ে স্বয়ং যজ্ঞ রক্ষার জন্য আশ্রয়ে গেলেন। পুনরায় আশ্রমে নায়ক নায়িকার দেখা হল। তখন রাজাকে একান্ত আপন করে না পাওয়ার জন্য শকুন্তলার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সঙ্গীন। কাজের অজুহাতে সখীরা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে নিভৃতে রেখে চলে গেলেন। নায়ক-নায়িকার নিভৃত মিলন ঘটল। গান্ধর্ব মতে উভয়ের বিবাহ হল। রাজা যজ্ঞান্তে শকুন্তলার আঙুলে নিজের নামাঙ্কিত আংটিটি পরিয়ে দিয়ে যথাসময়ে রাজধানীতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্রম থেকে বিদায় নিলেন।

   শকুন্তলা পতিচিন্তায় মগ্ন। এমন সময় মহর্ষি দুর্বাসা অতিথি হয়ে আশ্রমে এসে তাঁর আগমনবার্তা জানালেন। শকুন্তলা এতই আত্মবিস্মৃত যে মহর্ষি দুর্বাসার কণ্ঠ তাঁর কানে পৌঁছাল না। অতএব অতিথি অবমাননার দায়ে তাঁকে অভিশাপ পেতে হল। যাঁকে শকুন্তলা একমনে চিন্তা করতে করতে অতিথির উপস্থিতি জানতে পারলেন না, শকুন্তলার সেই প্রণয়ী তাঁকে স্মরণ করতে পারবেন না। প্রিয়ংবদা শাপ প্রত্যাহারের জন্য ঋষির পায়ে পড়লেন। ফলে শাপ কিছু হালকা হল। যদি কোনো অভিজ্ঞান আভরণ দেখানো যায় তাহলে শাপ দূরীভূত হবে। শকুন্তলার আঙুলে রাজার নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় আছে এই ভেবে দুই সখী আশ্বস্ত হলেন। শাপের বৃত্তান্ত শকুন্তলার কাছে গোপন রাখা হল। 

    অতঃপর মহর্ষি কণ্ব আশ্রমে ফিরলেন। তপঃপ্রভাবে ঋষি জানতে পারলেন দুষ্মন্ত শকুন্তলার বিবাহ বার্তা। অতএব শুরু হল শকুন্তলাকে রাজধানীতে পাঠাবার আয়োজন। শার্ঙ্গরব ও শারদ্বত নামক দুই শিষ্য এবং গৌতমীকে সঙ্গে দিয়ে শকুন্তলাকে পাঠানো হল রাজা দুষ্মন্তের কাছে। পথে শক্রাবতারে শচীতীর্থে বন্দনা কালে শকুন্তলার অলক্ষ্যে তাঁর আংটিটি জলে পড়ে যায়। শকুন্তলাকে রাজার কাছে আনা হলে দুর্বাসার শাপের প্রভাবে রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পারলেন না। শকুন্তলাও আংটিটি দেখাতে অসমর্থ হলেন। ফলে শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হল। মা মেনকা শকুন্তলার এই দুর্দশা দেখে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে মহর্ষি মারীচের আশ্রমে রাখলেন। সেইখানেই শকুন্তলার সর্বদমন তথা ভরত নামে এক পুত্র জন্মাল। 

    এদিকে যে মাছটি শকুন্তলা আংটিটি খাদ্যভ্রমে গিলেছিল, সেই মাছটি জেলের জালে ধরা পড়ল। ধীবর মাছটি কাটার সময় তার উদর থেকে উজ্জ্বল আংটিটি পেয়ে বিক্রি করতে গেলে সে রাজার লোকের হাতে ধরা পড়ল। রাজপুরুষগণ তাকে চোর ভেবে নিগ্রহ করতে লাগল। পরে আংটিটি রাজার কাছে পাঠানো হল। আংটি দর্শনমাত্রই রাজার শকুন্তলাবৃত্তান্ত মনে পড়ে গেল। শুরু হল অনুশোচনা। রাজা পশ্চাত্তাপে দগ্ধ হতে লাগলেন। 

    এমন সময় দেবরাজের সারথি মাতলির আবির্ভাব। দানব বিজয়ের জন্য রাজাকে যেতে হবে স্বর্গে। রাজা স্বর্গে গিয়ে দানব বিজয় করে ইন্দ্রের দ্বারা সম্মানিত হয়ে ফিরছেন আপন রাজ্যে। পথে মারীচমুনির আশ্রম। রাজা মহর্ষি মারীচ তথা কশ্যপকে প্রণাম করার জন্য তাঁর আশ্রমে গেলেন। সেখানে রাজার প্রথম মিলন হল সর্বদমন তথা ভরতের সঙ্গে। অতঃপর শকুন্তলার সঙ্গেও মিলন হল। তাঁরা মারীচ মুনির মুখে দুর্বাসার অভিশাপ বৃত্তান্ত শুনলেন। দু-জনের মন থেকেই মান-অভিমান দূরীভূত হল। দু-জনের পুনর্মিলন সুখপ্রদ হল। এখানেই নাটকের পরিসমাপ্তি।


 নাটকের উৎকর্ষ আলোচনা

সমালোচকগণ অভিজ্ঞানশকুন্তলা নাটকটি সম্বন্ধে বলেছেন – 

“কালিদাসস্য সর্বস্বমাভিজ্ঞানশকুন্তলম্।

 তত্রাপি চ চতুর্থাঙ্কো তত্র শ্লোকচতুষ্টয়ম্।।ʼʼ

   অভিজ্ঞানশকুন্তলা কালিদাসের সর্বস্ব কবিকৃতি। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার বহুলপ্রচারিত কাহিনিকে অবলম্বন করে রচিত হলেও কালিদাস নাটকটিতে নিজস্ব প্রতিভার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কালিদাস যদি আর কোনো কাব্য বা নাটক নাও লিখতেন, তবু এই একখানি নাটকই তাঁকে একাধারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকাররূপে যশোমণ্ডিত করে রাখত। বিশেষ করে চতুর্থ অঙ্কে আমরা প্রকৃতির কবি কালিদাসের পূর্ণ পরিচয় পাই। সেখানে কবি প্রকৃতির রূপবর্ণনায় এবং প্রকৃতিকে প্রকৃতি রেখে মানুষের সমধর্মীরূপে চিত্রিত করে মানুষেরই সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার করেছেন। প্রকৃতি সেখানে অনসূয়া-প্রিয়ংবদার মতোই একটি স্বতন্ত্র চরিত্র, যা শকুন্তলার সুখ-দুঃখকে সমানভাবে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে। এই অঙ্কে কালিদাস কবিরূপে স্বমহিমায় সমাসীন।

    অভিজ্ঞানশকুন্তলায় কবি কালিদাস যে এক কালজয়ী মানবচিত্তের আবেদন রেখে গেছেন, দুষ্মন্ত শকুন্তলার প্রেম কাহিনি ভুলে গেলেও সেই আবেদন চির উপভোগ্য হয়ে থাকবে। কন্যার পতিগৃহে যাবার সময় তার আবাল্য পরিচিত আত্মীয়, সঙ্গী ও পরিবেশের সঙ্গে অন্তরের যোগসূত্র ছিন্ন হওয়ার যে শাশ্বত বেদনা, তাকে কেন্দ্র করে মানুষ ও প্রকৃতির যে অন্তরঙ্গতার চিত্র কালিদাস অঙ্কিত করেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। নাটকের নায়ক-নায়িকাকে মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে, উভয়কে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করে, উভয়ের নিকট উভয়কে দুর্বোধ্য করে উভয়ের মধ্যে যে গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি কবি করেছেন, সেটাই নাটকের চরম মুহূর্ত। কবি মহাভারত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ থেকে নাটকীয় আখ্যানভাগ গ্রহণ করলেও, নাটকটি কলিদাসের কল্পকল্পনার অপরা সৃষ্টি। তপস্যা, সংযম ও নিষ্ঠা না থাকলে যে দেহনিষ্ঠ কাম দেহাতীত প্রেমে পরিণত হতে পারে না সেটাই কালিদাস এই নাটকে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। 

    শকুন্তলায় অভিশাপরূপ অলৌকিক ঘটনার দ্বারা নায়িকার আত্মশুদ্ধি এবং বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নায়কের আত্মোন্নতি সাহিত্যগত আদর্শের বিচারে অতীব মূল্যবান ও ইঙ্গিতবহ। কাহিনি বিন্যাস, চরিত্রচিত্রণ, প্রণয় ও সামাজিক আদর্শবোধের সংঘাত, রচনাশৈলীর উৎকর্ষ প্রভৃতি বিচারে এই নাটক নাট্যকারের শিল্পকুশলতার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

Post a Comment

0 Comments