মেঘদূতম
“কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে, কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে” মেঘদূত রচিত হয়েছিল সে কথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় না। জানা যায় না-
“কোথায় অবন্তীপুরী, নির্বিখ্যাতটিনী
কোথা শিপ্রা নদীতীরে হেরে উজ্জয়িনী স্বমহিমচ্ছটা।”
তবু মহাকবি কালিদাস রচিত মেঘদূত কবির এক অনুপম সৃষ্টি। ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যে যত গীতিকাব্য আছে, তার মধ্যে কালিদাসের মেঘদূত সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অনন্য। গীতিকাব্যের ইংরেজি প্রতিশব্দ Lyric । Lyric শব্দটি Lyre থেকে উৎপন্ন। Lyre শব্দের অর্থ তন্ত্রী। বীণার তন্ত্রীর ঝংকার যেমন সকলের চিত্তকে মোহিত করে, গীতিকাব্যের সুরঝংকার সেরূপ মানুষের মনকে মুগ্ধ করে। আলংকারিকগণ গীতিকাব্য বলে কোনো পৃথক কাব্যবিভাগ করেননি। তাঁরা খণ্ডকাব্যের নামোল্লেখ করেছেন। সুতরাং মেঘদূতকে একটি খণ্ডকাব্য বা দূতকাব্য বলা হয়। গীতিকাব্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন — “গীতের যে উদ্দেশ্য যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য তাহাই গীতিকাব্য। বকার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য সেই কাব্যই গীতিকাব্য।” যে কাব্যে কবির হৃদয়ের আত্মগত এক উচ্ছ্বসিত ভাবাবেগে আপন মূর্ছনায় অভিব্যক্ত হয়, তখন সেই কাব্যকে আমরা বলি গীতিকাব্য।
মেঘদূত নামক গীতিকাব্যটি কবি কালিদাসের এক অনুপম এবং অনবদ্য কবিকৃতি। মন্দাক্রান্তার ধীরললিত গম্ভীর বিন্যাসে প্রেমের আত্মকেন্দ্রিক চেতনায় গীতিকাব্যের সাম্রাজ্যে অতুলনীয় গৌরববাহী। গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ। কর্তব্যের অবহেলার জন্য প্রভুশাপে রামগিরির বিজন আশ্রমে নির্বাসিত যক্ষ আষাঢ়ের প্রথম দিবসে নববর্ষার নতুন মেঘকে দেখে অলকাপুরীর রম্য নিকেতনে বিরহিণী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে এক শুভবার্তা পাঠাতে মনস্থির করলেন। প্রেমিক যক্ষ জড় ও চেতনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মেঘকেই দূতরূপে পাঠাতে চান। রামগিরি থেকে অলকাপুরী অনেকখানি পথ। তাই চাই পথের নিশানা। নদ-নদী-নগরীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মেঘ অলকাপুরীতে পৌঁছে বিরহবিধুরা যক্ষপ্রিয়াকে দেখতে পাবে। পূর্বমেঘে আছে যাত্রাপথের বর্ণনা। মানস সরোবর, অমরকুট পর্বত, দশার্ণ জনপদ, বিদিশা নগরী, আম্রকূট শৈল, বিশীর্ণা রেবা নদী, বেত্রবতী, চর্মন্ধতী, শিপ্রা, দৃশদ্বতী, নির্বিন্ধ্যা, সিন্ধু প্রভৃতি নদনদী, ব্রহ্মাবর্ত, কুরুক্ষেত্র, দশপুর, উজ্জয়িনী প্রভৃতি জনপদ পার হয়ে মেঘ পৌঁছে যাবে যক্ষনিবাস সুরম্য অলকাপুরীতে।
উত্তরমেঘে আছে অলকাপুরী ও যক্ষপ্রিয়ার বর্ণনা। অলকাপুরীর গগনস্পর্শী অট্টালিকায় লাবণ্যময়ী ললনারা বিরাজিতা। সেখানে প্রণয়কলহ ভিন্ন কলহ নাই, যৌবন ভিন্ন বয়স নাই, আনন্দাশ্রু ভিন্ন অশ্রু নাই। সেখানে ইন্দ্ৰধনুতুল্য সচারু তোরণ, গৃহদীর্ঘিকার মরকত মণির সোপান। অলকাপুরীর সুন্দরীরা আদি-সৃষ্টি তিলোত্তমার ন্যায় অপরূপা সুন্দরী। তারা তন্বী-শ্যামা-শিখরিদশনা, পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী, চকিত হরিণীপ্রেক্ষণা। তাদের হাতে লীলাকমল, অলকে বালকুন্দ, মুখে লোপরাগের পাণ্ডুশ্রী, বেণীবন্ধে নরকুরবক পুষ্প। তারপর দেখা যাবে বিরহবিধুরা যক্ষপ্রিয়াকে। তিনি মলিনবসনা, একবেণীধরা। সেই বিরহিণীর কোলে রাখা বীণার তারগুলি চোখের জলে সিক্ত, বিনিদ্ররজনী যাপনের দুঃখে চোখ ফোলা ঠোঁটদুটি মলিন এইভাবে যক্ষবধূকে চিনতে পেরে মেঘ তাঁকে শুভবার্তা জানাবে - আর চারটে মাস পরেই যক্ষের শাপান্ত। এই কটা দিন যেন বিরহিণী বধু ধৈর্য ধরে প্রাণে বেঁচে থাকে।
কাব্যের উৎকর্ষ – শুদ্ধ বিরহকে অবলম্বন করে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ কাব্য মেঘদূত। রসবাদী সমালোচকদের মতে পার্থিব বিরহবেদনার বিশ্বব্যাপী অলৌকিক অনুভূতির আনন্দই হল মেঘদূতের বার্তা। প্রেমের অপূর্ণতাই বিরহ, প্রণয়ের অতৃপ্তিই বিরহের সাহিত্যকে মানুষের অন্তরে মহনীয় করে তোলে। দেহরতির যে আকূতি পুরুষ-প্রকৃতির মিলনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়, বিরহ-বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তাই শুচিস্নিগ্ধভাবে আদর্শে রমণীয়তা লাভ করে। আলোচ্য গ্রন্থে যক্ষের মনের আর্তি, তাঁর হৃদয়বেদনাকে যেভাবে আপন হৃদয়ের স্বতঃউৎসারিত অনুভূতি, সংবেদনশীলতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস দিয়ে কবি অভিব্যক্ত করেছেন, তাতে মনে হয় কবিই বুঝি কোনো দিন অনুরূপ দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন এবং আপন অনুভূতি, আপন দুঃসহ মনোবেদনা, অন্তরের প্রিয়াবেদনার হাহাকার যক্ষের মুখ নিয়ে ব্যক্ত করেছেন। কাব্যটিতে কমবেশি ১১৮টি (একশো আঠেরো) শ্লোক নিবন্ধ আছে। সব শ্লোকগুলিই মেঘমন্দ্র মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত, যা গীতের আকার ধারণ করেছে। মিলনের অপূর্ব ব্যাকুলতা, দুঃসহ বিরহবেদনা, অন্তরের ভাবোচ্ছ্বাস এবং ছন্দের সুমধুর ঝংকারের যুগপৎ সংমিশ্রণে কাব্যখানি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, চিত্তাকর্ষক এবং মনোরম হয়ে উঠেছে। সেই জনাই বিশ্বের সাহিত্যদরবারে মেঘদূত একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কবি কাব্যটিতে কেবলমাত্র যক্ষের হৃদয় বেদনাই ব্যক্ত করেননি, তিনি বিশ্বমানবের অন্তরের বেদনা এবং বিরহীজীবনের হাহাকার ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিগুরুর ভাষায় –
“কত সঙ্গীহীনজন প্রিয়াহীন ঘরে
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি উচ্চারণ
নিমগ্ন করেছে নিজ বিজন বেদন।”
মেঘদূত কাব্যখানি যতই পড়া যায় ততই যেন মনে হয় চিরনূতন। মনে সঞ্চারিত হয় নতুন নতুন রসের আস্বাদ। সেইজন্যই মল্লিনাথ বলেছেন- “মেঘে মাঘে গতং বয়ঃ”।
মেঘদূতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কালিদাস স্বকীয় প্রতিভাবলে যে দূতকাব্য রচনা করেছেন, তারই অনুকরণে বহু দূতকাব্য রচিত হয়েছে। পবনদূত, মনোদূত, হংসদূত, দেবদূত প্রভৃতি পঞ্চাশটি দূতকাব্যের উদ্ভব হয়েছে। সারা বিশ্বে মেঘদূতের প্রভাব লক্ষণীয়। বিভিন্ন ভাষায় মেঘদূতের বহু অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এটি একটি অতুলনীয় এবং উৎকৃষ্ট গীতিকাব্য এবং কালিদাসই এই দূতকাব্যের পথিকৃৎ।
0 Comments