গীতগোবিন্দ টীকা লেখো | উচ্চ-মাধ্যমিক সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

 

গীতগোবিন্দ কাব্যের বিষয়বস্তু | gitgobinda


গীতগােবিন্দ


জয়দেবের 'গীতগােবিন্দ' কাব্যটি প্রেমমূলক গীতিকাব্য হলেও সে প্রেম লৌকিক কামজ প্রেম নয়। সে প্রেম শুদ্ধ গঙ্গাজল, নিকষিত হেম, কামগন্ধহীন। এই কাব্যে প্রেম ও ভক্তি একাত্ম হয়ে পরমব্রহ্মের বিভূতিরূপে দেখা দিয়েছে। রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব এবং অলৌকিক বসন্তলীলা বর্ণনা করা হয়েছে এই কাব্যে। 

   এই কাব্যের নায়ক গােপীজনবৃন্দের প্রাণসখা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর নায়িকা হলেন গােপীকুলললামভূতা শ্রীরাধা। বসন্তকাল উপস্থিত। নায়ক এবং নায়িকা উভয়েই উভয়কে কাছে পেতে উৎসুক। শ্রীরাধার মনের আর্তি সখীমুখে জানতে পেরে কৃষ্ণ রাধাকে কুঞ্জে আসার জন্য অনুরােধ জানালেন। কিন্তু রাধার পক্ষে আসা সম্ভব নয় -তিনি কৃষ্ণকেই আসার জন্য অনুরােধ জানালেন। কৃষ্ণ আসবেন বলে সম্মতি জানালেন। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা অধীর আগ্রহে তাঁর পথ চেয়ে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কৃষ্ণ আসতে পারলেন না। অভিমানিনী রাধার মানসিক ক্ষোভ প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। কৃষ্ণ এলেন তার পরদিন। তীব্র ভর্ৎসনায় রাধা কৃষ্ণকে জর্জরিত করতে লাগলেন। পরে সখীদের উদ্যোগে এবং কৃষ্ণের কাকুতি-মিনতিতে রাধার ক্ষোভ দূরীভূত হল। কৃষ্ণ স্বস্তি পেলেন। 

   কাব্যটি দ্বাদশ সর্গে বিভক্ত। এই কাব্যে আছে আশিটি শ্লোক এবং চব্বিশটি গীত। গ্রন্থের প্রারম্ভে কবি জয়দেব দশাবতারের স্তোত্র করেছেন। তারপর কাব্যারম্ভে অর্থাৎ প্রথম সর্গে বিরহিণী রাধার শ্রীকৃষ্ণচিন্তা। দ্বিতীয় স্বর্গে আছে উভয়ের বিরহজনিত ব্যাকুলতা এবং পারস্পরিক মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তৃতীয় সর্গে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের রাধার জন্য উৎকণ্ঠা। চতুর্থ সর্গে সখীর দ্বারা কৃষ্ণের কাছে রাধার অবস্থা বর্ণন। পঞ্চম সর্গে অভিসারিণী রাধার প্রতীক্ষা। ষষ্ঠ সর্গে দেখা যায় শ্রীরাধা কর্তৃক প্রেরিত সংকেতে শ্রীকৃম্নের কোনাে কুণ্ঠা নেই -এরই সংক্ষিপ্ত বিবরণ। সপ্তম সর্গে শ্রীকৃষ্ণের অদর্শনে শ্রীরাধার আর্তি। অষ্টম সর্গে শ্রীকৃষ্ণের উপর রাধার অভিমান। নবম সর্গে শ্রীরাধার অভিমান দূর করার জন্য শ্রীকৃষের ঐকান্তিক প্রয়াস। দশম সর্গে শ্রীরাধার প্রতি কৃষ্ণুের অনুনয়-বিনয়। একাদশ সর্গে উভয়ের মিলনের সম্ভাবনা এবং দ্বাদশ সর্গে পারস্পরিক মিলন।

  কাব্যটি আধ্যাত্মিক রসে আপ্লুত একটি প্রেমকাব্য। এই একটি মাত্র কাব্যই জয়দেবকে বিশিষ্টতা দান করেছে এবং কবির অভিনব সাহিত্যকৃতির সাক্ষ্য বহন করে। দেহজ, কামজ প্রেমকে ভক্তিরসের অমৃতধারায় শুচিশুভ্র করে কবি তাকে দৈবলীলায় পর্যবসিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় ‘গীতের যে উদ্দেশ্য, যে কাব্যের সেটাই উদ্দেশ্য তাহাই গীতিকাব্য। বক্তার ভাবােচ্ছাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।' বৈষবকবি জয়দেবের ভাবােচ্ছ্বাস এখানে সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। সুতরাং গীতিকাব্য হিসাবে এটি সার্থক। মিলন-বিরহ, মান-অভিমান, প্রতীক্ষা এবং সাসপেন্স প্রভৃতি প্রেমের সকল অভিব্যক্তিগুলির চরম বিকাশ ঘটেছে। কবি এই কাব্যে এমন এক প্রেমের চিত্র অঙ্কন করেছেন, যে প্রেম 'স্মরগরলখণ্ডন'। কোমল কান্ত পদাবলিতে বাংলা ভাষার মতােই সকল শব্দসৌন্দর্য এই কাব্যে পরিলক্ষিত হয়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই কাব্য পাঠ করে ছন্দ-লালিত্যে মুগ্ধ হয়েই লিখেছেন-

“বাংলার রবি জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে 

করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন কোকনদে।”

Post a Comment

0 Comments